আফগান শাসন ও বারোভূঁইয়া

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - মধ্যযুগের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস (১২০৪ - ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) | NCTB BOOK

১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হলে একে একে বিদেশি শক্তিসমূহ গ্রাস করতে থাকে বাংলাকে । মুঘল সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছুকাল বাংলার রাজধানীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে আফগান নেতা শের শাহের কাছে পরাজয় মানতে হয় । বাংলা ও বিহার সরাসরি চলে আসে আফগানদের হাতে । আফগানদের দুই শাখা— শূর আফগান ও কররানি আফগানরা বেশ কিছুকাল বাংলা শাসন করেন । শেষ পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আকবর আফগানদের হাত থেকে বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেন । রাজধানী দখল করলেও মুঘলরা বাংলার অভ্যন্তরে অনেক দিন পর্যন্ত প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি । এ সময় বাংলায় অনেক বড় বড় স্বাধীন জমিদার ছিলেন। ‘বারোভূঁইয়া' নামে পরিচিত এ সকল জমিদার মুঘলদের অধিকার মেনে নেননি । সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সুবাদারগণ ‘বারোভূঁইয়াদের দমন করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি । ‘বারভূঁইয়া’দের দমন করা হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে ।

 

আফগান শাসন:

মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর পুত্র হুমায়ুন হুসেন শাহি যুগের শেষ দিক থেকেই চেষ্টা করেছিলেন বাংলাকে মুঘল অধিকারে নিয়ে আসতে। কিন্তু আফগানদের কারণে মুঘলদের এ উদ্দেশ্য প্রথম দিকে সফল হয়নি । আফগান নেতা শের খান শূরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সম্রাট হুমায়ুন। শের খানের পিতা হাসান খান শূর বিহারে অবস্থিত সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি জায়গিরদার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন । এ সময় বিহারের জায়গিরদার জালাল খান নাবালক বলে তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শের খান ।

সমগ্র ভারতের অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন ছিল শের খানের । তাই গোপনে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন । এ লক্ষ্যে অল্প সময়ের মধ্যে শের খান শক্তিশালী চুনার দুর্গ ও বিহার অধিকার করেন। তিনি ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দুইবার বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। এবার সতর্ক হন দিল্লির মুঘল সম্রাট হুমায়ুন । তিনি শের খানের পিছু ধাওয়া করে বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করে নেন। গৌড়ের চমৎকার প্রাসাদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন এর নামকরণ করেন ‘জান্নাতবাদ'। সম্রাট গৌড়ে ৬ মাস আমোদ-ফুর্তিতে গা ভাসিয়ে দেন । এ সুযোগে নিজের শক্তি বাড়াতে থাকেন শের খান। দিল্লি থেকে খবর আসে হুমায়ুনের সৎভাই হিন্দাল সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্র করছেন । এ খবর পেয়ে হুমায়ুন দিল্লির দিকে যাত্রা করেন । এ সুযোগ কাজে লাগান শের খান । তিনি ওঁত পেতে থাকেন বক্সারের নিকট চৌসা নাম স্থানে। গঙ্গা নদীর তীরে এ স্থানে হুমায়ুন পৌঁছালে শের খান তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপ্রস্তুত হুমায়ুন পরাজিত হন (১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ)।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের খান ‘শের শাহ' উপাধি নেন । তিনি নিজেকে বিহারের স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন । এবার বাংলার দিকে দৃষ্টি দেন তিনি । ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল শাসনকর্তা আলী কুলিকে পরাজিত করে তিনি বাংলা দখল করেন । এ বছরই তিনি হুমায়ুনকে কনৌজের নিকট বিলগ্রামের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন । এভাবে দীর্ঘদিন পর বাংলা আবার দিল্লির শাসনে চলে আসে। চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ শের শাহের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । শের শাহ শূর বংশের বলে এ সময়ের বাংলার শাসন ছিল শূর আফগান বংশের শাসন ।

শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ‘ইসলাম খান' নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি আট বছর (১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন । কিন্তু ইসলাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরোজ খানের সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে শূর বংশের মধ্যে দলাদলি শুরু হয় । শের খানের ভাগ্নে মুবারিজ খান ফিরোজ খানকে হত্যা করে ‘মুহম্মদ আদিল' নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন ।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে এ সময় বাংলা বিচ্ছিন্ন ছিল না। তাই ইসলাম খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার আফগান শাসক মুহম্মদ খান শূর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । উপাধি ধারণ করেন 'মুহম্মদ শাহ শূর'। এ সময় থেকে পরবর্তী বিশ বছর পর্যন্ত বাংলা স্বাধীন ছিল। মুহম্মদ শাহ শূর উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ আদিল শাহ শূরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন । তিনি জৌনপুর জয় করে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন । কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি পরাজিত ও নিহত হন ।

মুহম্মদ শাহ শূর নিহত হলে দিল্লির বাদশাহ আদিল শাহ শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । মুহম্মদ শাহের পুত্র খিজির খান তখন এলাহাবাদে অবস্থান করছিলেন । পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ' উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন । কিছুদিন পর তিনি শাহবাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন ।
এ সময় দিল্লির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। শের শাহের বংশধরদের দুর্বলতার সুযোগে মুঘল বাদশাহ হুয়ায়ুন স্বীয় রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন । কিন্তু দিল্লিতে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ পেলেন না। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করে শূর বংশীয় আফগান নেতৃবৃন্দকে একে একে দমন করার জন্য অগ্রসর হলেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) আদিল শাহের সেনাপতি হিমু মুঘল সৈন্যদের নিকট পরাজিত ও নিহত হন । এতে আদিল শাহ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন । অতঃপর তিনি বাংলার দিকে পলায়ন করেন । পথিমধ্যে সুরজগড়ের নিকটবর্তী ফতেহপুরে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ কর্তৃক এক যুদ্ধে ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আদিল শাহ পরাজিত ও নিহত হন ।

বাংলা বিজয়ী আফগান সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হলে মুঘল সেনাপতি খান -ই-জামান তাঁর গতিরোধ করেন। কূটকুশলী বাহাদুর শাহ খান-ই-জামানের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন । এরপর তিনি বাংলার বাইরে আর কোনো অভিযান চালাননি। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে
তাঁর মৃত্যু হয় ।

গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা জালালউদ্দিন শূর ‘দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন' উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনিও তাঁর ভ্রাতার ন্যায় মুঘলদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতেন । ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁর একমাত্র পুত্র বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর নাম জানা যায়নি । মাত্র সাত মাস রাজত্ব করার পর তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নামে জনৈক আফগান দলনেতা তাঁকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু তিনিও বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। কররানি বংশের রাজা তাজ খান কররানি গিয়াসউদ্দিনকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

তাজ খান কররানি ও সুলায়মান খান কররানি শের শাহের সেনাপতি ছিলেন। কনৌজের যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শের শাহ তাদের দক্ষিণ বিহারে জায়গির প্রদান করেন। ইসলাম শাহের রাজত্বকালে তাজ খান কররানি সেনাপতি ও কূটনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন । ইসলাম শাহের বালকপুত্র ও উত্তরাধিকারী ফিরোজের সময় তাজ খান উজির নিযুক্ত হন । ফিরোজকে হত্যা করে তাঁর মামা মুহম্মদ আদিল শূর সিংহাসনে বসেন। এ সময় তাজ খান কররানি পালিয়ে গিয়ে ভ্রাতাদের সহায়তায় দক্ষিণ বিহারে প্রাধান্য স্থাপন করেন । ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান কররানি নামমাত্র বাংলার সুলতান বাহাদুর শাহ শূরের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে পড়েন ।

বাংলার সিংহাসনের প্রতিও তাঁর দৃষ্টি ছিল । তিনি সুযোগের অন্বেষণে ছিলেন । অজ্ঞাতনামা গিয়াসউদ্দিন যখন শূর বংশের সিংহাসন দখল করেন, তখন সুযোগ বুঝে তাজ খান ও তাঁর ভ্রাতারা গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় দখল করেন। এভাবে তাজ খান কররানি বাংলায় কররানি বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । তাজ খান কররানির মৃত্যুর পর ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভাই সুলায়মান খান কররানি বাংলার সুলতান হন । এ দক্ষ শাসক আফগান নেতাদের তাঁর দলভুক্ত করেন। এভাবে বাংলা ও বিহারের অধিকাংশ এলাকা তাঁর অধিভুক্ত হয় । উড়িষ্যাতেও তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । সোলায়মান কররানির বিজ্ঞ উজির লোদি খানের পরামর্শে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন । তিনি সর্বপ্রথম গৌড় থেকে মালদহের ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তাণ্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে সোলায়মান কররানির মৃত্যু হলে পুত্র বায়জিদ সিংহাসনে বসেন । কিন্তু অল্পকাল পরেই এ অত্যাচারী সুলতানকে হত্যা করেন আফগান সর্দাররা । এবার সিংহাসনে বসেন সোলায়মান কররানির দ্বিতীয় পুত্র দাউদ কররানি । তিনিই ছিলেন বাংলায় শেষ আফগান শাসক । দাউদ কররানি খুব অদূরদর্শী শাসক ছিলেন । বিশাল রাজ্য ও ধন ঐশ্বর্য দেখে তিনি নিজেকে সম্রাট আকবরের সমকক্ষ ভাবতে থাকেন । এতদিন বাংলা ও বিহারের আফগান শাসকগণ প্রকাশ্যে মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন । কিন্তু দাউদ স্বাধীন সম্রাটের মতো 'বাদশাহ' উপাধি গ্রহণ করেন এবং নিজ নামে খুতবা পাঠ করেন ও মুদ্রা প্রচলন করেন ।

আফগানরা এমনিতেই মুঘলদের শত্রু ছিল । তার ওপর বাংলা-বিহার মুঘলদের অধিকারে না থাকায় সম্রাট আকবরের স্বস্তি ছিল না। দাউদ কররানির স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে আকবর ক্ষুব্ধ হন । প্রথমে আকবর জৌনপুরের শাসনকর্তা মুনিম খানকে নির্দেশ দেন কররানি রাজ্য আক্রমণ করতে । প্রথম দিকে সরাসরি আক্রমণ করেননি মুনিম খান । উজির লোদি খানের সাথে মুনিম খানের বন্ধুত্ব ছিল । দাউদ খান কররানি তাঁর উজির লোদির পরামর্শে মুনিম খানের সাথে ধনরত্ন দিয়ে আপোস করেন । কিন্তু অচিরেই এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। দাউদ খান কিছু ষড়যন্ত্রকারীর পরামর্শে ভুল বোঝেন উজির লোদিকে। দাউদ খানের নির্দেশে হত্যা করা হয় তাঁকে । লোদির বুদ্ধি আর বন্ধুত্বের গুণেই এতদিন মুঘল আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল বাংলা ও বিহার । তাঁর অনুপস্থিতিতে মুনিম খানের বাংলা ও বিহার আক্রমণে আর বাধা রইল না । মুনিম খান তার বন্ধু লোদির মৃত্যুর পর ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিহার থেকে আফগানদের হটিয়ে দেন । আফগানরা ইতোমধ্যে নিজেদের ভেতর বিবাদ করে দুর্বল হয়ে পড়েছিল । এ সুযোগে মুনিম খান বাংলার দিকে অগ্রসর হন । কররানিদের বাংলার রাজধানী ছিল তাণ্ডায়। আফগানরা বাংলার রাজধানী তাণ্ডা ছেড়ে পিছু হটে। আশ্রয় নেয় হুগলি জেলার সপ্তগ্রামে । মুনিম খানের নেতৃত্বে রাজধানী অধিকার করে মুঘল সৈন্যরা ও অগ্রসর হয় সপ্তগ্রামে । দাউদ খান পালিয়ে যান উড়িষ্যায় । মুনিম খান তাণ্ডায় বাংলার মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন । এ সময় তাণ্ডায় প্লেগ রোগ দেখা দিলে মুনিম খানসহ অনেক মুঘল সৈন্য এ রোগে মারা যান। ফলে বাংলায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । এ অবস্থার সুযোগে দাউদ কররানি পশ্চিম ও উত্তর বাংলা পুনরায় অধিকার করে নেন । অন্যদিকে ভাটি অঞ্চলের জমিদার ঈসা খান পূর্ব বাংলা থেকে মুঘল সৈন্যদের হটিয়ে দেন। মুঘল সৈন্যরা এবার বাংলা ছেড়ে বিহারে আশ্রয় নেয় ।

মুনিম খানের মৃত্যুসংবাদ আগ্রায় পৌঁছালে সম্রাট আকবর বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠান খানজাহান হুসেন কুলি খানকে । তাঁর সহকারী নিযুক্ত হন রাজা টোডরমল। বাংলায় প্রবেশপথে রাজমহলে মুঘল সৈন্যদের বাধা দেন দাউদ কররানি । মুঘলদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন বিহারের শাসনকর্তা মুজাফফর খান তুরবাতি । ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের নিকট মুঘল ও আফগানদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয় । রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররানির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে । পরে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় । এভাবে বাংলায় কররানি (আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়। অবশ্য ‘বারোভূঁইয়া'দের বাধার মুখে মুঘল শাসন বেশি দূর বিস্তৃত হতে পারেনি ।

 

বারোভূঁইয়াদের ইতিহাস:

সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার ওপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। বাংলার বড় বড় জমিদার মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি । জমিদারগণ তাঁদের নিজ নিজ জমিদারিতে স্বাধীন ছিলেন। তাঁদের শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী ও নৌবহর ছিল । স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁরা একজোট হয়ে মুঘল সেনাপতির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন । বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ 'বারোভূঁইয়া' নামে পরিচিত । এ ‘বারো' বলতে বারোজনের সংখ্যা বুঝায় না । ধারণা করা হয় অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারদের বোঝাতেই ‘বারো' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ।

বাংলার ইতিহাসে বারোভূঁইয়াদের আবির্ভাব ষোলো শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলোচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যাঁরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাঁরাই ‘বারোভূঁইয়া' । এছাড়াও, বঙ্গদেশে আরও অনেক ছোটখাটো জমিদার ছিলেন। তাঁরাও মুঘলদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ান । কিন্তু পরে তাঁরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। 

Content added By
Promotion